Writer : দীপ্তি মুখার্জ্জী মিশ্র ( শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষিকা, দিল্লি )
মূল প্রসঙ্গ, গোমূত্র ও গোবর ইত্যাদি নানাবিধ জিনিস আজকের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ? শুধুই কি ধর্মীয় কারণে এগুলো ব্যবহৃত হয়ে চলেছে বছরের পর বছর ধরে? নাকি এই পরম্পরারর মধ্যে সত্যই লুকিয়ে আছে কোন যাদু বা যুক্তি?
একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে যে গোমূত্র পান করার প্রথা সর্বপ্রথম শুরু হয় ভারতে নয়, রোমানিয়া দেশে। সুদূর রোমানিয়ায় দাঁত পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে গোমূত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। একদিন কোন এক রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দাঁত পরিষ্কার করার সময় ভুলবশত কিছুটা গোমূত্র পান করে ফেলেন। পরের দিন তিনি লক্ষ্য করেন, তাঁর সব রোগ সেরে গেছে এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। এর পরেই রোমানিয়া দেশে গোমূত্র পান করার প্রথা চালু হয় রোগ নিরাময়ের জন্য।
ভারতবর্ষের ভগবত পুরাণে স্বামী প্রভুপাদের অনুবাদে বলা আছে পঞ্চগব্য এর কথা। পঞ্চগব্য মানে, পাঁচটি উপাদান যা গরু থেকে পাওয়া যায়, যথাক্রমে দুধ, দই , ঘি, গোবর এবং মূত্র। এগুলি সবই ধর্মানুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো বৈদিক নিয়মানুসারে এবং আজও ব্যবহৃত হয়।
এদের মধ্যে গোমূত্র এবং গোবর , চিকিৎসার উপকরণ হিসেবেও মূল্যবান দ্রব্যাদি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পঞ্চগব্য এর ঔষধি ব্যবহার আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা আছে। সুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থে ( চিকিৎসা বিষয়ক সংস্কৃত গ্রন্থ) গরু থেকে প্রাপ্ত সব বস্তু গুলির মধ্যে গোমূত্র কে সবচেয়ে কার্যকরী বলে মনে করা হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো গরুর মুত্র নয়, বলা আছে যে, কুমারী গরুর মূত্র পান করাই শ্রেষ্ঠ এবং গর্ভবতী গরুর মূত্র সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর। এও বলা আছে যে গোমূত্রের ব্যবহারে প্রায় 40 রকমের অনারোগ্য রোগের এবং অন্যান্য সমস্যার নিরাময় করা সম্ভব। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও নিমপাতা ও গোমূত্র মিশ্রন দিয়ে খুব ভালো বায়োপেস্টিসাইড তৈরি করা যায়। গোমূত্র, প্রচলিত পরিষ্কার করার দ্রবণের অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। তাই প্রাচীনকাল থেকে আজও পর্যন্ত মেঝে পরিষ্কার করার জন্য গোবর এবং গোমূত্রের ব্যাপক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। আশ্চর্য হতে হয় জানলে যে গরুর গোবর এবং মূত্র দ্বারা বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে শ্যাম্পু।
অর্থাৎ এটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে গোমূত্র এবং গোবর অত্যন্ত উপকারী একটি জিনিস এবং এটি একটি প্রমাণিত ঘটনা।
অর্থাৎ ব্যাপারটা এইরকম নয় যে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে গোবর এবং গোমূত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে, বরং বলা যায় যে এই উপাদানগুলির গুণাবলীর কথা মাথায় রেখেই এগুলোকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপাদান হিসেবে রাখা হয়েছে।
আসলে তখনকার দিনে তথাকথিত আইন ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না, ছিল ধর্মীয় অনুশাসন। সেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাই কল্যাণকর বলে ধারণা করা হতো। এইভাবেই ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে সবার মঙ্গল সাধনের চেষ্টা করা হতো গোমূত্র ইত্যাদির সাহায্যে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা হতো এবং একথা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমানিত যে গোবর এবং গোমূত্র প্রকৃত রোগ নিরাময়কারী একটি জরুরী ওষধি উপাদান।
কিন্তু এই গোবর এবং গোমূত্র বর্তমানকালেও কি একই রকম ভাবে কার্যকরী ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, “বোধ হয় না”। একটু বুদ্ধি প্রয়োগ করলেই বোঝা যাবে কারনটা।
যে সময়ে এই রীতি নীতি গুলি মেনে চলা হতো সেগুলো ছিল নির্মল পরিবেশের দিন, সম্পূর্ণভাবে দূষণমুক্ত এবং কোনরকম বায়োবীয় জীবাণু বিহীন। তাই স্বভাবতই সেইসময়ের গরু এবং অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যদ্রব্য হতো সম্পূর্ণভাবে বিশুদ্ধ এবং অন্যান্য দ্রব্য ছিল সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত।
কিন্তু সেটা কতটা শুদ্ধ হবে আজকের দিনে যেখানে গরুকে ঘাস এর পরিবর্তে খাওয়ানো হচ্ছে নানা প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং কেমিক্যালে পরিপূর্ণ কৃত্রিম ভাবে প্রক্রিয়াজাত দ্রব্যাদি ? বেশি দুধের চাহিদার যোগান দেওয়ার জন্য সাহায্য নেওয়া হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্সেমিনেশন পদ্ধতির। ফলে কৃত্রিম উপায়ে গর্ভবতী হচ্ছে গরু।
কতটা শুদ্ধ হতে পারে তবে সেই গোমূত্র এবং গোবর ? বিবিসি নিউজ নিউজ এর সহায়তায় জানা যায় যে লন্ডনের বিশেষ বিশেষ জায়গায় পাওয়া যায় প্রক্রিয়াজাত গোমূত্রের বোতল। কিন্তু কতটা শুদ্ধ এই কেমিকাল এ পরিপূর্ণ কৃত্রিম ভাবে প্রক্রিয়াজাত ও গোমূত্র ?
তাই শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের জন্য গোমূত্রের ব্যবহার স্বীকৃত করা গেলেও আজকের দিনে সরাসরি এগুলি পান করে রোগ নিরাময়ের ইচ্ছা বোধহয় একান্তই বাতুলতা এবং হাস্যকর।
তাই নিজের বুদ্ধি বিবেচনা জাগ্রত করুন এবং অন্ধ অনুশাসনের পিছনে না ছুটে প্রকৃত রোগ নিরাময়ের নির্দেশাবলী মেনে চলুন।