প্রথম কবি ও প্রথম কাব্য

লেখক : উপেন্দ্রকিশোররায়চৌধুরী

তমসা নদীর ধারে বাল্মীকি মুনির তপোবন ছিল। দুধারে গভীর বন, তাহার মাঝখান দিয়া সুন্দর নদীটি কুলকুল করিয়া বহিতেছে। তাহার জল এতই পরিষ্কার যে তলার বালি অবধি স্পষ্ট দেখিতে পাওযা যায়। একটুও কাদা নাই, একগাছিও শ্যাওলা নাই। কাচের মতো টলমল করিতেছে।

বাল্মীকি নদীর ধারে বেড়াইতে আসিলেন, আর সেই নির্মল জল দেখিয়া তাহার মনে বড়ই সুখ হইল। সঙ্গে তাহার শিষ্য ভরদ্বাজ ছিলেন, তাহারে তিনি বলিলেন, “দেখ ভরদ্বাজ, নদীর জল কি নির্মল, যেমন সাধু লোকের মন। আমার বল্কল দাও, আমি এইখানে স্নান করিব।”

সেইখানে দুটি বক নদীর ধারে খেলা করিতেছিল। এমন সুন্দর দু’টি পাখি এবং তাহাদের এমন মিষ্ট ডাক, আর তাহারা মনের আনন্দে এমনি চমৎকার খেলা করিতেছিল যে দেখিয়া মুনি আর চোখ ফিরাইতে পারিলেন না। পাখি দুটির উপরে মুনির কেমন স্নেহ জন্মিয়া গেল, তিনি স্নানের কথা ভুলিয়া কেবলই তাহাদের খেলা দেখিতে লাগিলেন।

এমন সময় কোথা হইতে এক দুষ্ট ব্যাধ আসিয়া পাখি দুটির পানে তীর ছুঁড়িযা মারিল । এমন সুখে পাখি দুটি খেলা করিতেছিল, তাহাদের কোনো দোয্‌.ছিল না, কোনো বিপদের কথা তাহারা জানিত না। এমন নিরীহ জীবকে বধ করে, এমন  নিষ্ঠূর লোক হয় ? তীর খাইয়া পুরুষ পাখিটি যাতনায় ছটফট‌ করিতে লাগিল, মেয়েটি শোকে আর ভয়ে কাঁদিয়া আকুল হইল । মুনি আর এ দুঃখ সইতে না পারিয়া ব্যাধকে বলিলেন, “ওরে ব্যাধ, এমন সুখে পাখিটি খেলা করিতেছিল, তাহাকে তুই বধ করিলি ? তোর কখনই ভালো হইবে না!”

দয়ালু মুনির মনের দুঃখ তাহার চোখের জলের সঙ্গে সঙ্গে এই কথা গুলির ভিতর দিয়া ফুটিয়া বাহির হইল । সেই কথায় আপনা হইতেই ছন্দ আসিয়া আপনা হইতেই তাহা কবিতা হইয়া গেল। 

সেই কবিতাই সকলের প্রথম কবিতা, তাহার পূর্বে কেহ কবিতা রচনা  করে নাই।

মুনি আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এ কি চম্ৎকার কথা আমি বলিলাম !  আমি কিছুই জানি না, তবু ইহাতে বীণার ছন্দের মতন কেমন সুন্দর ছন্দ হইল!  ইহার চারিভাগে সমান সমান অক্ষর হইল!

আমি বলি, ইহার নাম ‘শ্লোক’ হউক, কেননা আমার শোকের সময় ইহা আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে।” .

ভরদ্বাজও বলিলেন, “গুরুদেব ! কি সুন্দর কথা, এমন কথা তো আর কেহ কখনো বলে নাই।

ইহার নাম শ্লোকই হউক।”

তারপর মুনি স্নান শেষ করিয়া ঘরে আসিয়া সেই পাখির আর সেই সুন্দর ছন্দের কথা ভাবিতেছেন, এমন সময় ব্রহ্মা আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। পাখি দুইটির দুঃখে কাতর হইয়া মুনি আর ব্রহ্মাকে অন্য কথা বলিবার অবসর পাইলেন না, তাহাকে সেই দুষ্ট ব্যাধের কথা বলিয়া সেই কবিতাটি গাহিয়া শুনাইলেন ।

তাহা শুনিয়া ব্রহ্মা বলিলেন, “বাল্মীকি,  তোমার এ কবিতার নাম শ্লোকই হউক । এইরূপ শ্লোক লিখিয়া তুমি রামের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে বড় সুন্দর কাহিনী, তাহা যে পড়িবে, তাহারই মঙ্গল হইবে। তুমি যাহা লিখিবে, তাহার একটি কথাও মিথ্যা হইবে না। যতদিন পৃথিবীতে পর্বত আর নদী সকল থাকিবে, ততদিন লোকে তোমার “রামায়ণে’র আদর করিবে। আর যতদিন রামায়ণের আদর থাকিবে, তুমি স্বর্গে গিয়া ততদিন আমার লোকে থাকিতে পাইবে”।

এই বলিয়া ব্রহ্মা চলিয়া গেলেন, আর তাহার কথাগুলি মনে করিয়া বালীকি বলিলেন, “এইরূপ মিষ্ট শ্রোক দিয়া আমি রামায়ণ রচনা করিব।”

তারপর সেই ধার্মিক মুনি কুশাসনে বসিয়া জোড়হাতে ভগবানকে স্মরণপূর্বক রামায়ণ লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে রামায়ণ শেষ হইল। তখন মুনি ভাবিলেন, “কাব্য তো শেষ হইল, এখন ইহা গাহিবে কে? ঠিক সেই সময়ে ‘কুশী’ ‘লব’ দুই ভাই আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিলেন। দুটি ভাই রামেরই পুত্র, মুনির বেশে সেই আশ্রমে থাকিয়া লেখাপড়া শিখেন। দেবতার মতন সুন্দর, গদ্ধর্বের মতন মিষ্ট গান গাহেন। মুনি বলিলেন, “এই আমার রামায়ণের উপযুক্ত গায়ক।”

সেই দুটি ভাইকে পরম যত্বের সহিত মুনি রামায়ণ শিক্ষা দিলেন। তারপর একদিন সকল মুনিদিগকে সভায় ডাকিয়া সেই রামায়ণের গান তাহাদিগকে শোনানো হইল। মুনিরা সকলে মোহিত হইয়া সে গান শুনিলেন, তাহাদের চোখ দিয়া দরদর ধারে জল পড়িতে লাগিল, আর মুখ দিয়া ক্রমাগত কেবল “আহা!” “আহা!” এই শব্দ বাহির হইতে লাগিল। শেষে তাহারা আর স্থির থাকিতে পারিলেন না । একজন মুনি তাহার নিকটে যাহা কিছু ছিল সকলই কুশি-লব কে দিয়া দিলেন । অন্যেরা কেহ বন্ধল, কেহ হরিণের ছাল, কেহ কমণ্ডলু , কেহ কুড়াল, কেহ কৌপীন দিলেন। একজন মুনি কাঠ আনিতে চাহিয়াছিলেন, সেই কাঠ বাঁধিবার  দাড়িগাছি ভিন্ন তাঁহার নিকটে আর কিচ্ছুই ছিল না । তিনি সেই দাড়িগাছিই কুশীলবকে দিয়া বারবার আশীর্বাদ করিলেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *